একাডেমিক প্রেজেন্টেশনের খুটিনাটি


প্রভাষক
লোকপ্রশাসন ও সরকার  পরিচালনা বিদ্যা বিভাগ, জাককানইবি  


বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে একজন শিক্ষার্থীর জন্য একাডেমিক প্রেজেন্টেশনের গুরুত্ব অপরিসীম। তবে প্রেজেন্টেশন নিয়ে অনেক শিক্ষার্থীরাই আতঙ্কগ্রস্ত হন বিশেষত স্নাতক প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের মাঝে এই বিষয় নিয়ে জটিলতা বেশি দেখা দেয়। এ সম্পর্কে পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক ও জিটিআই (গ্র্যাজুয়েট ট্রেনিং ইন্সটিটিউশন) ট্রেনিং প্রাপ্ত  ও বর্তমানে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন ও সরকার পরিচালনা বিদ্যা বিভাগের প্রভাষক তানজিল আহমেদ। 



আত্মবিশ্বাস 

একাডেমিক প্রেজেন্টেশনের ক্ষেত্রে প্রায়ই দেখা যায় শিক্ষার্থীরা অনেক নার্ভাস। প্রথমে একজন শিক্ষার্থীকে সেই নার্ভাসনেসকে কাটিয়ে উঠতে হবে এবং নিজের উপর এই বিশ্বাস রাখতে হবে 'আমি পারব'। আর এর জন্য প্রয়োজন ধৈর্যের সাথে অনুশীলন। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা ছোট ছোট গ্রুপ তৈরি করে প্রেজেন্টেশনের অনুশীলন করতে পারেন। পাশাপাশি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে প্রেজেন্টেশনের ভালো কিছু রেকর্ডেড ভিডিও দেখে (ইউটিউব একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হতে পারে) নিজে নিজে বাসায় অনুশীলন করতে পারেন। এতে শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাস বাড়বে।

ড্রেস আপ

প্রেজেন্টেশনে শিক্ষার্থীদের অবশ্যই মার্জিত, পরিষ্কার, এবং পরিচ্ছন্ন পোশাক পরিধান করা উচিত। এতে আত্মবিশ্বাস যেমন বাড়বে তেমনি শ্রোতারাও উপস্থাপকের প্রতি মুগ্ধ হবেন। তবে প্রেজেন্টেশনের পোশাক নির্বাচনের ক্ষেত্রে ফরমাল পোশাক নির্বাচন করাই শ্রেয়তর। অতি কালারফুল যেমন লাল, কালো, গোলাপি কিংবা হলুদ পোশাক পরিহার করা উচিত। ছেলে বা মেয়ে উভয়ের ক্ষেত্রেই সাদা, অফ হোয়াইট বা হালকা রঙের পোশাক পড়া উত্তম। পাশাপাশি পোশাক নির্বাচনের সময় অবশ্যই আবহাওয়া এবং সময়কাল বিবেচনা করতে হবে! অর্থাৎ গরমে শীতের পোশাক পরিহার করাই উত্তম।

ভাষা

ভাষা মানুষের মনের ভাব প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম। এক্ষেত্রে আমি মনে করি প্রেজেন্টেশনের ভাষা বাংলা, ইংরেজি বা মিক্সড উভয়ই হতে পারে। প্রেজেন্টেশনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো আপনি কতটা গুছিয়ে এবং সুন্দরভাবে আপনার সুনির্দিষ্ট বিষয়টি উপস্থাপন করতে পেরেছেন। তবে ক্ষেত্রবিশেষে ভাষা কেবল বাংলা বা ইংরেজি হতে পারে। যেমন কোন আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে আপনি কোন পেপার প্রেজেন্ট করলে সেক্ষেত্রে ভাষা অবশ্যই সহজ, সাবলীল ইংরেজি হওয়া উচিত যা আপনার শ্রোতারা খুব সহজেই বুঝতে পারবেন। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় একাডেমিক প্রেজেন্টেশনের ক্ষেত্রে ভাষার বিষয়টি শিথিল থাকা সত্ত্বেও অনেকে ভুল ইংরেজি ব্যবহার  করে প্রেজেন্টেশন করে। এতে প্রেজেন্টেটর যেমন নার্ভাস হয়ে যান তেমনি অন্যান্য শিক্ষার্থী/শ্রোতারাও প্রেজেন্টেশনে বিরক্ত হন। এক্ষেত্রে মাথায় রাখতে হবে আপনি ভাষার উপর প্রেজেন্টেশন করছেন না, বরং আপনার প্রেজেন্টেশনের বিষয়টি কতটা সহজ এবং সাবলীল ভাষায় উপস্থাপন করতে পারছেন সেটিই মুখ্য। তবে পড়াশোনা এবং পরীক্ষার মাধ্যম সম্পূর্ণ ইংরেজি হলে, সেক্ষেত্রে ইংরেজিতে প্রেজেন্টেশন করাটাই শ্রেয়। তাছাড়াও শ্রোতারা আপনার প্রেজেন্টেশনের বিষয়টি কীভাবে নিচ্ছেন বা উপস্থাপকের বক্তব্য বুঝতে পারছেন কি'না তার উপর ভিত্তি করে ভাষা নির্বাচন করা উচিত।

স্ট্যান্ডার্ড স্লাইড প্রিপারেশন

একাডেমিক প্রেজেন্টেশনে ভালো করার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো স্ট্যান্ডার্ড স্লাইড প্রস্তুত। যেখানে আপনার মূল প্রেজেন্টেশনের বিষয়টি চমৎকার ভাবে গুছানো থাকবে। এক্ষেত্রে আদর্শ PPT (PowerPoint Presentations) স্লাইড তৈরি করার সময় শিক্ষার্থীদের অবশ্যই স্লাইডের ব্যাকগ্রাউন্ড কালার, ফন্ট সাইজ এবং স্টাইল, স্লাইড নাম্বার ইত্যাদি বিবেচনা করতে হবে। একটি আদর্শ স্লাইডের ব্যাকগ্রাউন্ড কালার হোয়াইট এবং ফন্ট কালার ব্লাক হতে পারে। পাশাপাশি শিরোনামে ফন্ট সাইজ ৩৬ থেকে ৪০ এবং টেক্সটে ২৮-৩২ হতে পারে। লেখার ফন্ট স্টাইল Arial বা Times New Roman হতে পারে। অনেকেই একটি স্লাইডে ১০/১২ লাইন যুক্ত করেন এতে স্লাইডের লেখাগুলো খুব ছোট হয়ে যায় যা স্লাইডের লেখাগুলো পড়ার বা বুঝার ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি করে। মনে রাখতে হবে একটি স্ট্যান্ডার্ড স্লাইডে সর্বোচ্চ ৭-৮ লাইন হতে পারে। স্লাইডকে আকর্ষণীয় করতে প্রয়োজনে তথ্যচিত্র যুক্ত করা যেতে পারে। এতে শ্রেণীকক্ষের শেষ প্রান্তের শিক্ষার্থীরাও স্লাইডের বিষয়গুলো খুব সহজে বুঝতে পারবেন। 

প্রেজেন্টেশন গ্রামার

একাডেমিক প্রেজেন্টেশন ভালো করার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত হলো প্রেজেন্টেশন গ্রামার অনুসরণ করা। এক্ষেত্রে আই কন্টাক্ট, মুভমেন্ট, শব্দের উচ্চারণ, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ, ভারবাল এবং নন-ভারবাল কিউজ এর ব্যবহার, শ্রোতাদের সাথে ইন্টারেকশন্স এবং প্রশ্নোত্তর পর্ব ইত্যাদি প্রেজেন্টেশন গ্রামার এর অংশ। অনেক সময় দেখা যায় শিক্ষার্থীরা প্রেজেন্টেশনের সময় হাতে থাকা চিরকুট বা ল্যাপটপ থেকে শুধু রিডিং পড়ছেন কিংবা ডায়াসে হেলান দিয়ে দাড়িয়েছেন বা পকেটে হাত দিয়ে রেখেছেন, যা একজন প্রেজেন্টেটরের নার্ভাসনেস বা দুর্বলতাকে প্রকাশ করে। তাই প্রেজেন্টেশনের সময় অবশ্যই একজন শিক্ষার্থীকে এই বিষয়গুলোর প্রতি খেয়াল রাখতে হবে, পাশাপাশি প্রাণবন্ত থাকতে হবে! তবেই প্রেজেন্টেশন মনোমুগ্ধকর হবে।

সময়

পৃথিবীতে সকল ক্ষেত্রেই সময়ের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রেজেন্টেশনের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের অবশ্যই সময়ের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। এক্ষেত্রে প্রেজেন্টেশনের নির্ধারিত বিষয়টুকু অবশ্যই নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই শেষ করতে হবে। প্রয়োজনে বার বার অনুশীলন করে সময়ের বিষয় আয়ত্ত করতে হবে।

সুনির্দিষ্ট বিষয়ে প্রস্তুতি

সর্বোপরি একজন শিক্ষার্থীকে অবশ্যই তার প্রেজেন্টেশনের নির্ধারিত বিষয়ে ভালো প্রস্তুতি নিতে হবে। যে বিষয়ে প্রেজেন্টেশন করতে হবে সেই বিষয়ের আপডেট তথ্য, পরিসংখ্যানগত তথ্য এবং বাস্তবসম্মত বিষয়গুলো সম্পৃক্ত করতে পারলে অবশ্যই একজন শিক্ষার্থীদের প্রেজেন্টেশন মনোমুগ্ধকর হবে।

লেখক: প্রভাষক
লোকপ্রশাসন ও সরকার  পরিচালনা বিদ্যা বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ।


1 comment:

Theme images by Deejpilot. Powered by Blogger.